নাম ঝুঁকিভাতা। বাস্তবে অযথাভাতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষার কোটি কোটি টাকা ডাক্তারদের পকেটে যাওয়ার ঘটনায় সেখানে রোগীদের মুখে মুখে চলছে এমন মন্তব্য। এই পরীক্ষার টাকার আরেক নাম ইউজার ফি। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে রোগীরা এ হাসপাতালে এলে রোগ নির্ণয়ের জন্য দেওয়া হচ্ছে একগাদা টেস্ট। আর সেই টেস্ট করাতে রোগীরা যাচ্ছে প্যাথলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, মাইক্রোবায়োলজি, হেমাটলজি, রেডিওলজিসহ বিভিন্ন বিভাগে। সেখানে যাওয়ার পর রোগীদের কাছ থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফি বাবদ মোটা অংকের যে টাকা আদায় হচ্ছে তা ঝুঁকিভাতার নামে চলে যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট বিভাগের ডাক্তার, কর্মকর্তা-কর্মচারীর পকেটে। তবে এই ঝুঁকিভাতা আসলে কমিশন হিসেবেই বেশি পরিচিত। এমন খবরও রয়েছে যে, একজন অধ্যাপক যা বেতন পাচ্ছেন তার ৫ গুণ নিচ্ছেন কমিশন। যেমন একজন অধ্যাপকের বেতন ৮০ হাজার টাকা হলে মাসে কমিশন বা ঝুঁকিভাতা পান অন্তত ৫ লাখ টাকা। আবার যে কর্মচারীর বেতন ২০ হাজার টাকা তার কমিশন কমপক্ষে এক লাখ টাকা। তবে এই কমিশনের ভাগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন মেডিসিন, জেনারেল সার্জারি, গাইনি, নিউরো-সার্জারিসহ ক্লিনিক্যাল বিভাগের ডাক্তার-নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে বাধা না থাকলেও এত টাকা কমিশন অযৌক্তিক। এর বিরুদ্ধে অডিটেও অনেকবার আপত্তি উঠেছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধ্যাপকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষার টাকার বড় ভাগ নিলেও তাদের অনেকেই সরাসরি এক্স-রে, এমআরআই করেন না। শুধু রিপোর্ট দেন। তাতে রোগব্যাধির ঝুঁকি নেই। অথচ ঝুঁকিভাতার ভাগ বেশি। এ কাজগুলো সর্বক্ষণ করে যাচ্ছেন রেডিওগ্রাফার। রক্তসহ অন্যান্য পরীক্ষার বেশিরভাগ করেন টেকনোলজিস্টরা। কোনো সমস্যা হলে বা জটিল মনে হলে অধ্যাপকরা স্লাইট দেখতে আসেন, নইলে নিজের কক্ষে বসে রিপোর্টে স্বাক্ষর করছেন। কখনো লেকচার দিচ্ছেন, কখনো প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সময় দিচ্ছেন, কখনো কক্ষে গল্প করছেন, না হয় চিকিৎসাবিষয়ক বই পড়ছেন। কিছুদিন আগে হাসপাতালটির বি-ব্লকের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগে দেখা গিয়েছিল এমন একটি বই পড়ার চিত্র। সেখানে নিজের কক্ষে বসে বসে বই পড়ছিলেন অধ্যাপক ডা. মোজাম্মেল হক। এ সময় একজন গরিব রোগীর টেস্ট ফ্রি করাতে চাইলে তিনি মুখ বরাবর না করে দেন। হতাশ হয়ে ফিরে যায় রোগীটি। অথচ নিয়ম হচ্ছে ৫০ ভাগ ফ্রি বেডের রোগীদের বিনামূল্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা দেওয়ার। বহির্বিভাগের গরিব রোগীরাও ফ্রি পরীক্ষা করাতে পারবে। কেবল এই মোজাম্মেল হকই নন, গরিব রোগীদের ফ্রি টেস্টে মন খারাপ করে ফেলেন অন্যান্য বেসিক বিভাগের অধ্যাপকরাও। এমনই একজন রেডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এনায়েত করিম। তার কাছে রোগীরা ফ্রি টেস্ট করাতে গিয়ে কখনো হাসিমুখ দেখেনি। মুখ ভার করে বেশিরভাগ রোগীকেই তিনি ফিরিয়ে দেন। এ রকম ব্যবহার করতে দেখা যাচ্ছে আরও অধ্যাপক ও বিভাগীয় চেয়ারম্যানদের। কারণ ফ্রি দিলেই তো তাদের ভাগে কম পড়ে যাবে। তাদের চেষ্টা থাকে আয় বাড়ানোর। যত আয় তত কমিশন। আর তাতে কপাল পুড়ছে রোগীদের। বিশেষ করে গরিব রোগীরা বড় অংকের ফি দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে পারছে না। এর মধ্যে হেমাটলজি বিভাগে আসা ব্লাড ক্যান্সারের রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এই কমিশনের টাকা বেশি নেওয়ার জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফি-ও বেশি নেওয়া হচ্ছে। আর এতে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছে রোগীরা। রোগীরা যেন ফ্রি পরীক্ষা করাতে না পারে তাই নিয়ম-কানুন রাখা হয়েছে কড়া। এই ঘাট, ওই ঘাট পেরিয়ে ক্লান্ত হওয়ার ভয়ে অনেক সময় গরিব রোগীরাও বাধ্য হয় টাকা দিয়ে পরীক্ষা করাতে। অথচ সরকার থেকে বছরে কোটি কোটি টাকা অনুদান দেওয়া হচ্ছে হাসপাতালটিকে। নিজস্ব আয় তো আছেই। এই বাড়তি ফি এবং কমিশনের টাকা নিয়ে যেমন রোগী ও তাদের স্বজনরা বিরক্ত, তেমনি ভাগের টাকা না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন ক্লিনিকেল বিভাগের ডাক্তাররাও। তারা বলছেন, রোগীকে সরাসরি তারাই দেখছেন এবং অপারেশন করছেন, তাই ঝুঁকিভাতা বা কমিশন তাদেরই প্রাপ্য। অথচ সব টাকা নিয়ে যাচ্ছে প্যাথলজি, বায়োকেমেস্ট্রি, মাইক্রোবায়োলজি, ভাইরোলজি, রেডিওলজিসহ বেসিক সায়েন্সের ডাক্তাররা। এই কথা মানতে রাজি নন বেসিক সায়েন্সের ডাক্তাররা। তারা বলছেন রক্তের নমুনা পরীক্ষা কিংবা এক্স-রে, এমআরআই, সিটিস্ক্যান পরীক্ষায় রোগব্যাধির ঝুঁকি মারাত্মক। জীবনের ঝুঁকিও কম নয়। এজন্যই ঝুঁকিভাতা হিসেবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ইউজার ফি-র একটি অংশ নিচ্ছেন। এটি বৈধ এবং যৌক্তিক। এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আলী আজগর মোড়ল আমার সংবাদকে বলেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে প্রাপ্ত আয়ের ৩০ শতাংশ কমিশন পাচ্ছেন বেসিক বিভাগের ডাক্তার, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। অডিটে বিষয়টি সম্পর্কে আপত্তি আসার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন বিভাগের প্রো-ভিসি অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটি একটি প্রতিবেদনও দিয়েছে। এখন কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন করার প্রক্রিয়া চলছে। জানা গেছে, কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী বেসিক বিভাগের ডাক্তার-কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা মূল বেতনের বেশি কমিশন নিতে পারবেন না। বাকি টাকা বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের ক্লিনিকেল বিভাগ যেমন মেডিসিন, সার্জারি, গাইনিসহ অন্যান্য বিভাগের ডাক্তার-নার্স, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বোনাস হিসেবে দেওয়া যেতে পারে।
Design & Developed BY- zahidit.com
Leave a Reply